বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৩

হিমু


আচ্ছা এই হিমু কেস্ টা কী? সায়কায়াট্রিস্ট প্রশ্ন করেন লেখককে।

উনি ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতে চান। তার চারজন পেশেন্ট – তিনজন ছেলে, একজন মেয়ে। চারজনই বলে তারা হিমু হয়েছে। এই হওয়াটার মাত্রা অস্বাভাবিক- ওদের মধ্যে দু’জন এখন ড্রাগের উপর থাকে। লেখককে ওদের সাথে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হল।

লেখক ওদের হিমু নিয়ে প্রশ্ন করে, হিমু কি কোন পীর? একজন উত্তর দেয়- হিমু পীরের বাবা। পৃথিবীর প্রত্যেক শহরে একটা করে হিমু আছে, ওরা পুরো শহরটাকে কন্ট্রোল করে। উত্তরদাতার কনফিডেন্সে লেখক চমৎকৃত। নিজের সৃষ্টির উপর তার আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। হিমু তার নাগালের বাইরে নিজের মত করে উপকথা তৈরী করে চলেছে, এমনই তার ক্ষমতা।

লেখকের সাথে প্রায়ই পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবী পরা খালি পায়ে যুবকদের আলাপ হয়। দেশে, এমনকি দেশান্তরে। কিছুজন হিমু হওয়ার রুলস জানতে চান। জানতে চান প্রত্যেক পূর্ণিমায় জঙ্গলে যাওয়া কম্পালসরী কিনা, এক দু’বার মিস হলে কি হবে। লেখক কিছু রুলস বানিয়ে দেন । ১৮র নিচে হলে চলবে না। খুব গরমে বা ঠান্ডায় চটি পরা যেতে পারে। পুলিস, র‌্যাব এদের সাথে হিমু সুলভ রসিকতা একদম না, এইরকম আর কি। হিমু রোগ ছোঁয়াচে ব্যাধির আকার নেয়। সদ্য তরুণ তরুণীদের মধ্যে যার প্রকোপ সর্বাধিক। উপন্যাসে হিমুর বিয়ে দেওয়ার কথা শুনেই প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সাহিত্যিক বন্ধুরা। এ সবই সত্য ঘটনা। এরপর যা আসছে, তা হল হিমু ধর্ম মন্দির প্রতিষ্ঠা, হিমুকেই দুনিয়ার সব নৈরাজ্যবাদীদের নেতা ঘোষণা করা। সরকার কর্ত্তৃক হিমু পুস্তক ব্যান।


আচ্ছা, হিমুকে এত পাত্তা দেওয়ার কোন মানে হয়? একটি বিশেষ বয়সকালের যুববৃন্দ বলবেন, অবশ্যই হয়, আমরা তো সবাই হিমু হতে চাই। এর কারণ হল: ক) উল্টা কাজ করার, তামাম দুনিয়া ভন্ডুল করার তাগিদ এদের সব থেকে বেশী। খ) ফিল্ম-স্টার দের নকল করতে গেলে কিছুটা কসরত লাগে, চুলের স্টাইল থেকে জুতোর ব্র্যান্ড। হিমুর চুলের স্টাইল কেউ জানে না। হিমুর দৈর্ঘ্য, ওজন কি? একটা হলুদ পাঞ্জাবী পরে খালি পায়ে বেরিয়ে গেলেই হয়। একটু হাঁটাহাঁটি করা, একটু হেঁয়ালি করে কথা বলা। হ্যাঁ, ওটি ভাল করে রপ্ত করা চাই, ওটি একটি শিল্প।

জনৈক হাবিলদার অবশ্য যুববৃন্দের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন। হিমু কে জানতে চাওয়া হলে উনি একবার বলেন- ‘ও একটা ফালতু, একেবারে ফালতু-উল্টাপাল্টা কথা কয়ে লোকের মন আওলা করে দেয়।’ হিমুর খালা, খালু, ফুপা, ফুপু তিনবার মাথা নেড়ে বক্তব্যটির সমর্থন করবেন। তিনবার কেন? তিন সংখ্যাটির একটা বিশেষ তাৎপর্য্য আছে, হিমু বলেছিল একবার, খেয়াল করে দেখতে হবে। এখন এসব তুচ্ছ ডিটেলস চুলোই যাক, না কি? অলরেডী হিমু জগতের কাল্পনিক চরিত্ররা ঢুকে পড়েছে। বাস্তব ব্যাকফুটে।

হিমু চেতনা জাঁকিয়ে বসার আগে আমি ছোট্ট করে আমার কথাটি বলে নিই। আমি একজন হিমু ফ্যান। আমাকে যখন লিখতে বলা হল হিমু নিয়ে, আমি খুশী তো হই ই তার সাথে চুড়ান্ত কনফিডেন্ট ও। ভাবটা এমন, আরে, শেষে হিমু, ও তো আমারি খাস লোক। আমার ক্যাম্পের মানুষ, যেন সত্যি সত্যি আমরা এক টেন্টে সঙ্গী ছিলাম বহু রাত, কোন এক অভিযানের পথে (অভিযানের নাম দেওয়া যাক- প্রোজেক্ট মহাপুরুষ- আর কারা কারা ছিল সেখানে? জায়গাটার নাম নাহয় পরে ঠিক করা যাবে।)

(এই চিন্তাটাই বিভ্রান্তিকর। ওই যে লেখার শুরুতে যে ছেলেগুলোর কথা বললাম, ওরাও ঠিক এরকম ভাবে, ভাবে হিমু ওদের লোক। এই আপন হয়ে যাওয়াটা হিমুর খেলা- মাইন্ড গেম নাম্বার ওয়ান। হিমু নিজেই এক জায়গায় স্বীকার করেছে- আমি যখন যার সাথে থাকি, ঠিক তারমত হয়ে যাই, তার মত কথা বলি, ফকিরের সাথে ফকির, চোরের সাথে চোর। এটি এক অসাধারণ প্রতিভা। গল্পের চরিত্রদের সাথে পাঠকরাও এই খেলার অঙ্গ হয়ে যায় নিজের অজান্তে।)

সে যাই হোক, ওই মন আওলা করে দেওয়ার ব্যাপারে আসি। ওটার একটা কায়দা আছে। হিমু কায়দা। হিমুর সাথে কথোপকথনে অনেক সময় যায়, হিমু কিন্ত নিজে বলে কম। যা বলে সহজ, স্বাভাবিক। মনে হবে একটি থিওরেম এর স্টেপ পর স্টেপের ভেতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রথম কথার পিঠে দ্বিতীয় কথাটি আসার এক চরম নিশ্চয়তা আছে।

পাঠক ও সেই মুহুর্তের শ্রোতা তাতে আকৃষ্ট হবেই,কারণ মানব মস্তিষ্ক স্ট্রাকচার ভালবাসে, অর্ডার কে আঁকড়ে ধরতে চায়, তার মনের যাবতীয় কষ্টের মূলে একটি অমীমাংসিত নৈরাজ্য, আর তার থেকে মুক্তি অর্ডার, যে কারণে সংগীত বা গণিতে সব কিছু ভুলে ডুবে থাকা যায়। হিমুর কথা তার মনের একটা অংশকে নাড়া দেয়, তাকে হিমুর প্রতি রিসেপ্টিভ করে তোলে, যদিও অন্য অংশ বলে, ‘তুমি খুব বেশী কথা বলছ, এখন গেট লস্ট।’ অথচ সে হিমুর ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে, আর ওই লজিকাল স্টেপ গুলির ফাঁকে ফাঁকে, হিমু গাদা গাদা পাগলামীর মশলা গুজে দিচ্ছে। হিমু চলে যাবার পরও তার মনে ক্রিয়া করতে থাকে হিমু-লজিক। অবশেষে আবেগময় ঊত্তরণ হয়। তার মনের নৈরাজ্য দূর হল বটে, কিন্ত তাকে রিপ্লেস করে লজিকের বদলে এক সুস্থির স্টেবল আউলাপনা ঠিক যেমনটি হিমু চায়। চোখে টলটল করে ওঠে পানী। হিমু এত কিছু কান্ড ঘটিয়েও এই আবেগের বৃত্ত থেকে নিজেকে সযত্নে বাইরে রাখে। রাখতে পারে। এতে সাহায্য করে হিমুর ছোটবেলার মহাপুরুষ ওয়ার্কশপের সি ই ও, ট্রেনার, পরম পূজনীয় হিমুর বাবার ঐতিহাসিক বাণী।

‘আবেগ বিষ্ঠার মত, আবেগ কে শরীর হইতে নির্মূল করিতে হইবে।… আবেগশূন্য না হইলে অন্যের আবেগ বুঝিতে পারিবে না’।

এই আউলাপনার ফল হয় মারাত্মক। যার যেখানে থাকার কথা না, সে সেখানে চলে যায়। বিপ্লব বলব না, স্থান কাল চরিত্রের একটা পারমুটেশন ঘটে। যা হিমু গল্পগুলোর হিউমারের মূলে। প্রতাপশালী পুলিশ অফিসার হাতির বাচ্চা উপহার দিতে কিশোরীর দোরগোড়ায় হাজির হ্য়, লক-আপে বসে ক্রিমিনাল হিমুর সাথে স্বচ্ছন্দে সব্জির দাম আর আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে। মোসলেম মিয়া, পাপ ধুতে, প্রথম বৃষ্টিতে সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে উলঙ্গ হয়ে নাচেন। জনজীবন স্তব্ধ হয়। ইন্টেলিজেন্স অফিসার সব অনুসন্ধান ছেড়ে হিমুর মেসের ঘরে ভুড়িভোজ খেয়ে দিনের পর দিন ভোঁসভোঁস করে ঘুমোন। আমেরিকাবাসী গম্ভীর প্রকৃতির এন আর আই ভদ্রমহিলার সব মায়া প্রবাহিত হয় এক বস্তিবাসী শিশুর দিকে। রাস্তার দুই বাইন্ডুলে চ্যাংড়া, হিমুর বড়লোক ফুপার সাথে বসে স্কচ সেবন করে, ফুপার ফিলসফি শোনে, ফুপার মনে হয় তারা পরম আত্মীয়। এই রকম প্রচুর উদাহরণে প্রায়শই একটি সোশাল মবিলিটির ট্রেন্ড স্পষ্ট- সমাজের নিম্নস্তরের মানুষদের খুব সাবলীল ভাবে উচ্চশ্রেনীর মানুষদের সাথে মার্জ করানোর এজেন্ডা, চ্যাংড়া ফাজিল ছোটলোকদের হিমু ভাই এর নেতৃত্ত্বে বড়লোক গম্ভীর বড়সাহেবদের বৈঠকখানায় অনুপ্রবেশের বৈপ্লবিক প্লান। না, হিমুর কোন রাজনৈতিক আদর্শ নেই, সাম্য আনার কোন দায় নেয় তার, লেখকের একটা মেসেজ থাকলেও থাকতে পারে, হিমুর জন্য, ওই আগে যা বললাম, যার যেখানে থাকার কথা নয় তাকে ঠিক সেখানে পৌঁছে দেওয়ার এক অদ্ভুত শিশু/হিমু সুলভ মজা।

হিমুর প্রেমে পড়ে মেয়েরা। পড়বেই। (হিমু অনুযায়ী, মেয়েরা একবার মুগ্ধ হলে, সেই মুগ্ধতা থামে না, কন্টীনিউ করে, ছেলেরা মুগ্ধতা নিয়ে অস্বস্তিতে থাকে, তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালায়)।. হিমু যথাসাধ্য তাদের খুশী করে (হিমু নিজেই এক জায়গায় বলেছে, তার চেহারায় ‘আই এম অফ সার্ভিস’ গোছের কিছু লেখা আছে, যেটা বিশেষত মেয়েরা দেখতে পায়), কিন্ত তাদের প্রেম ফেরাতে পারে না। প্রেম নিয়ে হিমুর একটা থিওরী আছে। ত্থিওরীটা হল, প্রত্যেক মানুষের কাছে পাঁচটা করে নীলপদ্ম আছে, সেগুলো নিয়ে মানুষ ঘোরে, সেগুলোকে দিয়ে যেতে হবে, কাউকে না কাউকে। (আচ্ছা, পাঁচটাই কেন? ) নীলপদ্ম দেয়ানেয়ার কিছু নিয়মকানুন আছে। তবে এতে হিমুর কি? হিমুকে সাঙ্কেতিক ভাষায় প্রেমপত্র লিখলে, হিমু তার সাঙ্কেতিক জবাব দেয়, -------, যার অর্থ – ‘আই লাভ ইউ, আই মিস উ, আই লস্ট ইউ’ – এর যে কোন একটা। হিমুর নায়িকারা এমনিতেই একটু বেশী অভিমানী আর রাগী হয়, এ সব হেঁয়ালীতে তাদের রাগ হয় ডাবল। রাগী মেয়ে হিমুর পছন্দ, তাদের রাগিয়ে মজা আছে, আবার তাদের টুকটাক খুশী করার জন্য সে মিথ্যার বন্যা বইয়ে দিতে পারে – কানের দুল নিয়ে, শাড়ির রং নিয়ে, মানানসই চোখের চশমা নিয়ে বিজ্ঞ মতামত দিতে পারে, রাস্তা পার হবার সুবিধের জন্য হাত তুলে সব ট্রাফিক থামিয়ে দিতে পারে। হিমুর মত সৌন্দর্যের উপাসক ও সমঝদার নেই, নারী সৌন্দর্যে সে তার মুগ্ধতা লুকোয় না, কিন্ত এরকম কোন মেয়ে হিমুর সাথে হাত ধরে পূর্ণিমার রাতে খালি পায়ে হাঁটার প্রস্তাব রাখলে হিমু বলে, সঙ্গে আসতে পার, তবে হাত ধরা যাবে না, হিমুরা কারো হাত ধরে না।

খালারা পড়েন মুস্কিলে। যেন তেন প্রকারেণ হিমুর বিয়ে দিতে হবে যে, তাতে যদি হাঁটাহাঁটি একটূ কমে। (প্রসঙ্গতঃ, খালারা না থাকলে হিমুর হিমু হওয়া বেরিয়ে যেত, বেকার হয়ে দিনের পর দিন চালানো, তার ওপর গরীবদের দানছত্র খোলার জন্য পেছনে হাজার হোক একটা সাপোর্ট চাই, যদিও অনেকে বলবেন, এগুলো সবই হিমুর আধ্যাত্মিক ভেল্কিবাজির প্রতিদানে খালার উপহার, খালার হিমুকে প্রয়োজন, উল্টোটা নয়, তবুও এরকম খালা থাকলে বাংলাদেশের কিছুজন হিমু হতে পারত, তাই খালাদের সালাম)।. কিন্তু হিমুর বিয়ে হয় না, হিমু খালাদের সাথে ফাজলামী মারে, প্রচুর মিথ্যে কথাও বলে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে, কিন্তু সেভাবে বলে না, প্রতিশ্রুতিও রাখে, তবে সেভাবে নয়।

বাংলাদেশের পুলিশ বা র‌্যাব যদিও খালার থেকে একটু অসহিষ্ণু, এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত কথার যাদুতে, পকেটহীন পাঞ্জাবীর অদৃশ্য পকেটে হিমু তাদের অনায়াসে পুরে ফেলে। কিছু কিছু থানার ও সি তো হিমু ভাইয়ের নাম শুনলেই বিগলিত হয়ে যান। হিমু আবার কোন শুভকাজ লাগলে থানায় এসে দাওয়াত দিতে ভোলে না।

অদ্ভুত সম্পর্ক! হিমুর যে জিনিসটা তাদের সবচেয়ে চমকায়, তা হল, হিমুর আনপ্রেডিক্টেবিলিটি। হিমু পরমুহূর্তের কি বলবে বা করবে, তা কেউ জানে না। অথচ এই অনিশ্চয়তার মধ্যে কোথাও কোন অস্থিরতা নেই। এটায় হিমুর এসেন্স। এটা ছড়িয়ে আছে, হিমুর চরিত্রে, ডায়লগে, হিমু উপন্যাসগুলোর গঠনে। হিমুর বাবা বলেছিলেন, ‘চন্দ্র, সুর্য, গ্রহ সর্বদা চলমান, কিন্ত তাদের এই গতিতে কোথাও কোন অস্থিরতা পাইবে না। প্রকৃতির নিয়মে অস্থিরতার স্থান নাই। আজ হইতে তোমার জীবনে অস্থিরতা নিষিদ্ধ হইল।’ হিমুর উপন্যাসগুলির শেষে আমরা যে স্বস্তিটা পাই, তা শুধুই শুভ সমাপ্তি জনিত ‘অল ইজ ওয়েল উইথ দ্য ওয়ার্ল্ড’ অনুভূতি নয়, মানসিক স্থিরতাও তার একটি প্রধান অংশ।

লেখক নিজে একবার লিখেছিলেন- হিমু ইন্টিউশান-এ চলে, মিশির আলি লজিকে। হিমুকে কিন্ত অনেক সময় দেখা যায়, আপাতদৃষ্টিতে একটি অলৌকিক ঘটনার, সহজ যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক বা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে। এতে তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ক্রেডিট চলে যাবে জেনেও, সেটা দেয় সে, কারণ সে জানে সংশ্লিষ্ট মানুষটি ততক্ষণে তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে মেনে নিয়েছে, ম্যাজিকের সাথেই সে ‘এট হোম’ ফিল করছে, অতএব তাকে নেক্সট রাউন্ড অফ চমকানোর জন্য আমদানি কর যুক্তি। মানুষকে চমকানোর সুযোগ হিমু কি কখনো ছাড়ে। বাদলের গলায় কাঁটা লেগেছে, কিছুতেই যাচ্ছে না, বাড়ী জুড়ে শোকের ছায়া, হিমু ভাই এসে মজার মজার কথা বলে বাদলকে হাল্কা করে দিল, তার মন ঘোরাল, এতে তার গলার মাসল, যেটা এতক্ষন টেনশনে শক্ত ছিল, কিছুটা রিলাক্স হল, তারপর একসাথে গরম ভাত আর মাখন খেল দু’জনে। কাঁটা ভ্যানিশ। পুলিশের বড়কর্তার হিমুকে থাপ্পড় মারতে গিয়ে স্ট্রোক হয়, কোমা থেকে আসার পর উনি খালি দেখেন হিমু হলুদ পাঙ্গাবী পরে হাসিমুখে তার দিকে হাত বাড়িয়ে । সবাই বলে, হিমু পীর, হিমু স্বপ্নে দেখা দিচ্ছে, হিমু বলে, বড়কর্তার জ্ঞান হারানোর আগে শেষ ইমেজটা হিমুর, তাই সেটা ব্রেনে গঁেথে গেছে। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, তার ভবিষ্যৎ দেখার একটা বড় উপায় হল, মানুষকে খুব ভাল করে বোঝা, একটা মানুষ একটা বিশেষ অবস্থায় পড়লে কি ভাবে রিএক্ট করবে তা খুব ভাল করে জানা।

হিমুর নিজের ব্রেন যেহেতু বেশ স্বাধীন, হিমু অবাধে ক্ষুদ্র ডিটেলস-এ বিচরণ করে যায়। এটা আমরা পারব না। কারণ হিমুর কাছে, ভবিষ্যতের উপর বর্তমানের, ক্ষুদ্র প্রাণী, নদী, আসবাব, এদের ওপর এই মুহূর্তের মানুষের কোন বিশেষ স্থান নেই। সবি এক প্লেনে বিরাজমান। যখন যা মনে ধরে, তাতে হিমু চলে যায়, ভেসে যায়। হিমুর সাথে যারা বিশেষ দরকারী আলোচনা করে তারা এগুলোতে বিরক্ত হয়, ভাবে অপ্রাসঙ্গিক। এই যেমন পাঁচটা নীলপদ্ম কেন, তিনটে কেন নয়, এ নিয়ে নিশ্চয় হিমুর এক থিওরী থাকত, বা এই যে আমি লিখেছিলাম, টেন্ট এর কথা, হিমু আমার মত সেটা পাশ কাটিয়ে চলে যেত না, সেই অভিযান এর জায়গাটার একটা নাম দিত, সেলসিয়াস স্কেলে গ্রীষ্ম ও শীতে দুই ডেসিমাল ফিগার অব্দি দিনরাতের তাপমাত্রার একটা নিউমারিকাল এস্টিমেট দিত, সেখানকার পাখিদের আকৃতি নিয়ে বলত, গন্তব্যে পৌঁছনোর পর আমার আর ওর একটা পুরো কাল্পনিক ডায়লগ নামিয়ে দিত। এক সম্পূর্ণ নতুন দুনিয়া অনায়াসে কথায় কথায় চলে আসত, আর মিলিয়ে যেত……।

আচ্ছা হিমুর হিমুত্ব কি কোনদিন শেষ হবে? হতেই পারে এই হিমুর বাবা লোকটি, নর্মান বেটসের মা-এর মত হিমু্রই তৈরি এক কন্সট্রাক্ট, তার বাণীগুলি সব হিমুর বানানো, ছোটবেলার চূড়ান্ত আবেগময় কোন স্মৃতিকে আটকানোর প্রয়াসে এক সুচতুর ডিফেন্স মেকানিসম। না, হিমু সাইকো নয়, যদিও এই আপাত আবেগহীনতা দেখে একজন হিমুকে সিরিয়াল কিলার বলেছিলেন। সিরিয়াল কিলার আর মহাপুরুষের বিভাজন রেখা কি এত্ই সরু? কিন্ত হিমুর তো কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রতিও মায়া আছে, ও তো জড়পদার্থেও কাল্পনিক প্রাণ সঞ্চার করে, রোগীর সাথে হাসপাতালে দেখা করতে এলে, প্রথমে জীবাণুদের কুশল জিজ্ঞেস করে, বলে ‘হ্যালো জীবাণু।’ হিমু কোন কিলার নয়, আমরা জানি, হিমু এক সংবেদনশীল, পরম মমতাময় মানুষ।

বা মসীহা। যাকে ইশ্বর বঙ্গ দেশে পাঠিয়েছেন বিশেষ কাজে। ‘এ দেশের লোক বড়ই সিনিকাল, নিজ বুদ্ধির উপর বড়ই ঘ্যাম ইহাদের, মার্ক্সবাদী নাস্তিকতা ও ভ্রান্ত মৌলবাদে ইহারা গা ভাসায়, এদের বাগে আনা সহজ নয়, তার উপর ইহারা অলস, ধর্মীয় বিধি পালনের কঠোরতা ইহাদের জন্য নহে। তুমি যাও উহাদের ফাজলামীর বিপরীতে তিনগুণ ফাজলামী করিয়া মন আওলা করিয়া দিয়া এস।’

ব্যাস। হলুদ পাঞ্জাবী আর খালি পায়ে সটান ঢাকার রাস্তায়। আর আমরা পেছনে হাঁটছি। কেউ কেউ আবার সেই ড্রাগ এডিক্ট যুবকটির মত হাঁটার তৎপরতায় হিমুকেও ওভারটেক করে বেরিয়ে যাচ্ছে। অতি-হিমু বলে কি কিছু হয়? হলেও, ওটা কোন কাজের কথা নয়। হিমু হওয়াতেই বাহাদুরি। আসুন, আমরা হিমুর পা ফেলা মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করি। হিমুর সঙ্গে হাঁটি।

লিখেছেন – ঋতেন মিত্র

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন