সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৩

মেহমাননামা


ছোট বেলায় আমাদের বাসায় কিছু অদ্ভুত ধরণের মেহমান আসতেন এবং উনাদের সাথে আনা গিফট ও থাদ্য সামগ্রী গুলোও ছিল অদ্ভুত ধরণের ! তার মধ্যে কমন দুটো থাবার ছিল 'পাইনএপেল' বিস্কুট এবং 'তালের বড়া' ( তালের রস দিয়ে বানানো সুপারি সাইজের এক ধরণের ভাজা মিষ্টি খাবার । যা মিষ্টান্ন দোকানে তৈরি করে ) !

তো, যদি কখনো টের পেতাম যে, কোন মেহমান আসছেন, তখন সবার আগে দৌড়ে মেহমানের কাছে পৌঁছে যেতাম । ছুঁ মেরে হাতে থাকা পাইনএপেলের প্যাকেট নিয়ে খড়ের গাদায় লুকিয়ে যেতাম । নিজেকে তখন সোনা জয়ী হান্টার জিম করবেট মনে হতো !

পাইনএপেল বিস্কুট প্যাকেটের সব চেয়ে বড় রহস্য ছিল এর ভেতরে থাকা কাগজের জরির আবরণ ! বুঝা দায় ছিল ঠিক জরির কতোটা ভেতরে বিস্কুট লুকিয়ে আছে ! জরি খুলতাম আর খুলতাম । অবশেষে মিলতো সবে ধন নীল মনি ! আনারসের কি মন মাতানো ঘ্রাণ ছিল ! খেতেও দারুণ স্বাদ ছিল । বিস্কুট অর্ধেক খেয়ে অর্ধেক রেখে দিতাম পরে খাব বলে । কারণ মেহমানদের সাথে পিচ্চি একটা মেয়েকেও দেখেছি যে !

হিন্দি সিনেমায় একটা কথা প্রায়শই শুনি যে, মেহমান ভগবান কি তারাহ হোতা হ্যায় ! আমাদের বাসায়ও ছিল ঠিক সে রকম রীতি । মেহমান মানেই ধুমধাম উত্‍সব । পিঁঠা-পুলি, আড্ডা, গল্প আর মজার মজার সব খাবারের বিশাল সমারোহ । কারণ সব চেয়ে সেরা রাঁধুণি যে আমার মা ! আমি থাকতাম সব চেয়ে ব্যস্ত মানুষ । বাবার সাথে রিকসায় করে বাজারে যেতাম । বড় মাছটা, বড় মোরগটা ( তখন ব্রয়লারের মোরগি পাওয়া যেতো না ) আমিই পছন্দ করতাম । সব চেয়ে আনন্দের যে বিষয়টা ছিল তা হলো, যতো দিন মেহমান থাকতো, ততো দিন আমাকে রাতে পড়তে বসতে হতো না !

মেহমানরা যে দিন চলে যাবেন, সে দিন সকালটায় সবাই মন খারাপ করে থাকতেন । চলে যাবার সময় খালারা, ফুফুরা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন । মাকে দাওয়াত দিতেন উনাদের ওখানে বেড়াতে যেতে । মা ও উনাদের আবার আসতে বলতেন । অনেকটা পথ আমরা সবাই মিলে মেহমানদের এগিয়ে দিতাম ।

উনাদের কেউ কেউ কখনো সখনো আমার হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট গুজে দিতেন । বলতেন, মজা খাইয়ো । আমার মনে আছে, সেই পাঁচ টাকার নোটটি আমি ভাঁজ করে অনেক দিন পর্যন্ত পকেটে রেখে দিতাম । খরচ করতাম না । তখন আমার কাছে সেই পাঁচ টাকার নোটটিই ছিল পৃথিবীর সব চেয়ে বড় টাকার নোট !

তারপর অনেক দিন পর কোন মুদি দোকানে গিয়ে এক টাকার বাদাম কিনতাম । এক টাকার বাদামেই পুরো দিন পার হয়ে যেতো ! কি মুগ্ধকর শৈশবই না ছিল আমার । আফসোস, যদি হাজার বছরের যৌবন দিয়ে আমার শৈশবের একটা দিন ফিরে পেতাম !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন